দ্রৌপদী মুর্মুর জীবন কাহিনী । ক্লার্ক থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ?
আজ আমরা জানবো পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষের একজন লড়াকু নারী সৈনিকের জীবন কাহিনী। যিনি নিজের হার না মানার মানসিকতা , অদম্য জেদ, নিরলস পরিশ্রম এবং Women Empowerment এর অনবদ্য নিদর্শন হিসেবে হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারিনী হিসেবে আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে প্রথম ,এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে ভারতবর্ষের ১৫ তম রাষ্ট্রপতি রূপে মনোনীত হতে চলেছেন।
একজন ক্লার্ক থেকে জীবনের যাত্রা পথ শুরু করে এখনো পর্যন্ত তিনিই ঝাড়খণ্ডের প্রথম এবং একমাত্র রাজ্যপাল , যিনি রাজ্যপাল হিসেবে পূর্ণ সময়কাল পার করেছেন। এছাড়াও তিনিই ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল।
আশা করছি আপনারা বুঝেই গেছেন আমি কার কথা বলতে চলেছি? হ্যাঁ আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চলেছি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবন কাহিনী।
তখনকার সময়ের ওড়িশা ছিল ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম আর বিশেষত এসসি এসটি ওবিসি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে একজন নারী হিসেবে দম্পতি মুরগির উত্থান যেন হার না মানা একজন সফল বীর যোদ্ধার কাহিনী, যা কোটিকোটি মানুষের অনুপ্রেরণা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। যা আমাদের জীবন সংগ্রামের হার না মানার শিক্ষা দিয়ে যায়।
অন্যদিকে হাজারো রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে আমাদেরকে আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভারত বর্ষ কেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র যেখানে একজন চা ওয়ালা প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে আবার অন্যদিকে একজন আদিবাসী নারী বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন।
সালটা ১৯৫৮ সাল, তারিখটা ২০ শে জুন, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলার কুসুমী ব্লকের উপরবেদা গ্রামে এক Tribal পরিবারে দ্রৌপদী মুর্মু জন্মগ্রহণ করেন।
উনার পিতার নাম বিরচী নারায়ণ টুডু। ছোটবেলা থেকেই দ্রৌপদী দেবীকে লড়াই করতে হয়েছিল চরম ক্ষুধা এবং দারিদ্রতার সাথে l তৎকালীন ভারতবর্ষের একজন সাঁওতাল কন্যা সন্তানের জন্য শিক্ষা গ্রহণ খুব কঠিন একটা লড়াই ছিল। চরম কষ্টের মধ্যেও তিনি উচ্চশিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। ভুবনেশ্বরের রমা দেবী উইমেন্স কলেজ থেকে দ্রৌপদী দেবী নিজের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
দ্রৌপদী দেবীর পরিচয় বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে শুরু হলেও উনার কর্মজীবন শুরু হয় ওড়িশার সেচ ও বিদ্যুৎ দপ্তরে একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ক্লার্ক হিসাবে । ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দ্রৌপদী দেবী সেচ দপ্তরের এই ক্লার্কের চাকরি করেছিলেন ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারের অধ্যক্ষ হিসেবে হিসেবে কাজ করেন । বর্তমানে যেটি ইউনিভার্সিটি অফ ভুবনেশ্বর সেই রমা দেবী ওমেন্স কলেজে তিনি সান্মানিক সহকারী শিক্ষক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন ।
পারিবারিক জীবনেও দ্রৌপদী দেবীকে অনেক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করতে হয়েছিল । দ্রৌপদী দেবীর এক মেয়ে এবং দুই ছেলে নিয়ে গড়ে ওঠা পরিবারেরও নেমে এসেছিল একাধিক কঠোর আঘাত। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্রৌপদী দেবীর স্বামী শ্যামচরণ মূর্মুর মৃত্যু হয় । এর কিছু সময় পর ২০০৯ সালে উনার এক ছেলের অকাল মৃত্যু ঘটে। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। এখানেই শেষ নয় ,২০১২ সালে এক রোড এক্সিডেন্টে ওনার আরেক ছেলেও মারা যান । একের পর এক অঘটন ঘটে গিয়েছিল দ্রৌপদী দেবীর পরিবারে । এর পরেও আয়রন লেডির মত এক মেয়েকে নিয়ে উনি নিজেকে সামলান এবং নিজের মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন । যিনি বর্তমানে বিবাহিতা এবং ইউকো ব্যাংকে কর্মরতা।
বছর ৬৪ দ্রৌপদী মুর্মু একজন দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ। উনার রাজনৈতিক জীবন অন্তত আড়াই দশকের ।দল থেকে আইনসভা, রাজভবন থেকে রাইসিনা হিলের রাজনৈতিক যাত্রাপথ শুরু হয় ১৯৯৭ সালে রাই-রংপুর পুরো ভোটে জিতে কাউন্সিলার হিসেবে । সেইসঙ্গে রাইরংপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারপারসনের দায়িত্ব ও সামলান তিনি। এরই সাথে ১৯৯৭ সালেই তিনি বিজেপির রাজ্য আদিবাসী সংগঠনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন । ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ৬ বছর ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব সামলানোর আগে পর্যন্ত , তিনি দুবার MLA হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০০-২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি Minister of Commerce & Transportation দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ত্ব সামলান । আবার ২০০২-২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি মৎস্য এবং পশুপালন দপ্তরের মন্ত্রিত্ব সামলান। তিনি ২০১৫ সালে বিজেপির আদিবাসী সংগঠনের জাতীয় কার্যনীবাহী সদস্যপদ লাভ করেন।
শূন্য থেকে লড়াই শুরু করা দ্রৌপদী মুর্মু ছিলেন একজন যোগ্য এবং কর্মঠ মহিলা । বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তিনি ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজ্যপাল , যিনি নিজের প্রশাসনিক দক্ষতায় পূর্ণ সময়কাল বহাল ছিলেন । তিনি তার সৎনিষ্ঠ এবং কর্মঠ জীবনধারার পুরস্কার হিসেবে ২০০৭ সালে বেস্ট MLA অ্যাওয়ার্ড 'নীলকন্ঠ সম্মানে' ভূষিত হন। ২০২২ সালে ভারতের ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির দ্বারা রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হয়ে তিনি ভারতবর্ষের প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। খুব সম্ভবত ২৫শে জুলাই সেইদিন যেদিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ তার প্রমাণ স্বরুপ ভারতের আয়রন লেডি দ্রৌপদী মুর্মুকে , আমরা দেশের দেশের পঞ্চদশ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাইসিনা হিলস এর নতুন বাসিন্দা হিসেবে দেখতে পাবো। একজন সাঁওতাল পরিবারের জন্মগ্রহণ করা আদিবাসী মহিলা কিভাবে জীবন সংগ্রামে লড়াই করে একজন সাধারণ ক্লার্ক থেকে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যাক্তিতে পরিণত হতে চলেছে সেই জীবন সংগ্রামের কাহিনী আপনাদের কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না । আর এই পোস্টটি শেয়ার করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লড়াই করে যাওয়া সমস্ত যোদ্ধাদের কাছে হার না মানার বার্তা দিয়ে তাদের জীবন যুদ্ধে পাশে থাকুন, একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে।
Comments
Post a Comment