ভারতের ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ২০২২
আজ ১৫ ই আগস্ট, সারা ভারতবর্ষের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় , প্রতিটি স্কুল কলেজে , অফিস আদালতে , ক্লাবে ক্লাবে পালিত হচ্ছে এক মহোৎসব। স্বাধীনতার মহোৎসব । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মের মানুষ পালন করছে ভারতে ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৭ সালে আজকের দিনেই অত্যাচারী ব্রিটিশদের ১৯০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তার জন্য আমাদের দিতে হয়েছে শত সহস্র বীর বিপ্লবীদের তরতাজা প্রাণের বলিদান। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কোহিমা, অসমুদ্র হিমাচলের প্রতিটা কোণে মহা পরাক্রমের সাথে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতের জাতীয় পতাকা যখন উত্তোলিত হয় , যখন স্পিকারে বেজে ওঠে 'সারে জাহা সে আচ্ছা অ্যা হিন্দুস্তা হামারা' , তখন প্রতিটা ভারতবাসীর গা শিহরিত হয়ে ওঠে । এবং দেশপ্রেমের আবেগে মন আন্দোলিত হয়ে পড়ে।
প্রবল অত্যাচারী ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করা খুব একটা সহজ গল্পের মত ছিল না। এই স্বাধীনতার ভিত্তি ছিল আমাদের দেশের বীর বিপ্লবীদের সাহসী এবং রক্তময় সংগ্রাম। আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখি সপ্তদশ শতকে ভারতবর্ষে গাছ অরন্দাজ পর্তুগিজের সাথে সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অর্থ বল, ক্ষমতা বল ,এবং কুবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সারা ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখলের লোভে এরা মত্ত হয়ে ওঠে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে হারিয়ে বাংলায় কোম্পানি শাসনের সূচনা করে ইংরেজরা। এবং এরপরে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে নেয় এই অত্যাচারী ব্রিটিশরা। বণিকের মানদণ্ড পরিণত হয় রাজদণ্ডে। আর এই শাসন মানে শুধুই শাসন ছিল না । এই শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল অমানুষিক অত্যাচার , শোষণ এবং নিপীড়ন।
লাগামছাড়া অত্যাচারে বিধ্বস্ত ছিল দেশের প্রতিটি মানুষ । তখন প্রতিটি মানুষ যেন ছিল ইংরেজদের গোলাম । ছিল না বাক স্বাধীনতাও, অবস্থাটা এতটাই করুন ছিল, যে একজন চাষী তার নিজের জমিতে নিজের ইচ্ছে মতো ফসল ফলাতে পারতো না । জোর করে অলাপ জনক পরিস্থিতিতে নীল চাষে বাধ্য করার গল্প তো আমরা সবাই জানি । চাষে অসম্মত হলে চলত বড়পূর্বক বর্বর অত্যাচার । কেড়ে নেওয়া হতো চাষীর শেষ সম্বল জমিটুকুও । শোষণের তীব্রতা এতটাই ছিল ,যেখানে কর প্রদান করতে গিয়ে সর্বোচ্চ খুঁইয়ে ফেলতে হতো সাধারণ মানুষদের। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা শ্রেণীর মানুষ পরাধীন ছিল । একদিকে অত্যাচার এবং অমানুষিক শোষণ লাগাম ছাড়া ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল । ভারতবর্ষ লুঠ করে ইংরেজরা সমস্ত অর্থ ইংল্যান্ডে পাচার করছিলো। আর অন্যদিকে এ অবস্থায় বীর সাহসী যোদ্ধাদের পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ চুপ করে বসে থাকবে এটা কখনোই সম্ভব ছিলো না । ইংরেজদের এই মাত্রা ছাড়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে থাকে একের পর এক বীর বিপ্লবীদের সাহসিকতা । শুরু হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের যাত্রাপথ । ১৮৫৫ সালে জমিদারি ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে বিদ্যমান। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমবারের জন্য সংঘটিত হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভাবে বিদ্রোহ । সেনা ছাউনি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আগুন । অনেক বীর বিপ্লবী নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেন । মঙ্গল পান্ডে , নানা সাহেব , তাতিয়া টোপি, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ , প্রমুখেরা বীর বিক্রমের সাথে লড়াই করে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেন। আর এরপর ভারতের মহান প্রান বীর বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের দ্বারা গড়ে উঠতে থাকে চরম প্রতিরোধ।
সারা বিশ্ব যখন সহিংসতায় মত্ত, তখন গান্ধীজি আউড়ে ছিলেন অহিংসার বাণী । গান্ধীজীর কথায় 'যদি তুমি পৃথিবীকে বদলাতে চাও, তবে আগে নিজেকে বদলাও' । গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস পথে অসহযোগ আন্দোলন আইন অমান্য আন্দোলন ভারত ছাড়ো আন্দোলন ডান্ডি অভিযান ইত্যাদি ইংরেজদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। জনমানুষে এর প্রভাবও ছিল বিস্তর ।
আর অন্যদিকে চরমপন্থী বিপ্লবীরা বিশ্বাস করতেন, অত্যাচারী এই ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে । আর দেশপ্রেমের আগুনে জ্বলতে থাকা এই সমস্ত বীর বিপ্লবীদের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা আজকের এই স্বাধীনতা । দেশপ্রেমের আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে হাসতে হাসতে হাসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন সদ্য কিশোর হওয়া ক্ষুদিরাম বোস । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণীর বীর বিপ্লবীরা দিয়েছিলেন নিজেদের প্রাণের বলিদান। ভগত সিং ,যতীন দাস , মাস্টারদা সূর্যসেন , লাল-বাল-পাল , বিনয়-বাদল-দীনেশ , স্যার সৈয়দ আহমেদ খান , প্রমূখের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমাদের চোখে জল এনে দিতে বাধ্য।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদানও ছিল অনস্বীকার্য। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার , মাতঙ্গিনী হাজরা , কনকলতা বড়ুয়া , রানী লক্ষ্মীবাঈ , বীণা দাস , অরুনা আসেফ আলী সহ বীরাঙ্গনা নারীরা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে এনে দিয়েছেন আজকের আমাদের এই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান আলাদাভাবে না বললেই নয় । নেতাজির মতে 'স্বাধীনতা এমনি এমনি আসবে না ,স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে '। আর 'শত্রুর শত্রু , আমার মিত্র' নীতি অনুসরণ করে নেতাজি গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ । সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আজাদ হিন্দ ফৌজ দখল করে নিয়েছিলেন মনিপুরের একটা বড় অংশ।এবং ১৯৪৫ সালেই সেখানে ওঠে আমাদের তেরঙ্গা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী এতসব বীর যোদ্ধা রয়েছেন ,যাদের অবদান বলে শেষ করা যাবেনা । একদিকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে নরমপন্থী অহিংস আন্দোলন , অন্যদিকে অগণিত বীর বিপ্লবীদের সশস্ত্র আন্দোলন - ব্রিটিশ শাসনের ভীত কে চরমভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল । আর এ সমস্ত বীরযোদ্ধাদের বীরত্ব ও ও আত্মত্যাগের ফলস্বরূপ দীর্ঘ দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট , অর্থাৎ আজকের দিনে আমাদের দেশ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
বহু রক্তক্ষয়ের ফসল হিসেবে স্বাধীনতা আসলেও তার সাথে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বুকে এক সুতীব্র আঘাত নেমে আসে । ধর্মের ভিত্তিতে রাতারাতি ভাগ হয়ে যায় দুটি আলাদা আলাদা দেশে । একদিকে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান নামক একটি দেশের সৃষ্টি হয় । আর অন্যদিকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম , ধর্মনিরপেক্ষ ,গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বর্ষ নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে । বেশতো স্বাধীন হলো কিন্তু বুকের মধ্যে রয়ে গেল দেশ ভাগের তীব্র যন্ত্রণা। ১৫ ই আগস্ট দিনটি একদিকে আমাদের মনে করায় অগণিত বীর শহীদদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতা তেমনি অন্যদিকে স্বজন হারানোর তীব্র যন্ত্রণা একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির অপার আনন্দ।
সর্বস্ব হারিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি , স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার । অনেকের কাছে এই 'স্বাধীনতা' মানে যা ইচ্ছে তা করার অধিকার । কিন্তু বাস্তবে এই 'স্বাধীনতা' আমাদের ক্ষুদ্রতর অর্থে ব্যবহার করলে চলবে না এই ' স্বাধীনতার ' ভিত্তি হতে হবে বৃহত্তর। ব্যক্তিগত , ধর্মীয় , এবং রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আমাদের এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে । মনে রাখতে হবে আমাদের এই স্বাধীনতার বাণী।
আমাদের দেশের গৌরব রক্ষা করতে হবে । ধর্মের নামে, স্বার্থের নামে , রাজনীতির নামে , হানাহানি হিংসা-বিদ্বেষের উপরে উঠে ,আমাদের স্বাধীন হতে হবে । আমাদের স্বাধীন হতে হবে সংকীর্ণ ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে । আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমাদের জন্মভূমি ভারত বর্ষ বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আজ আমরা পৃথিবী ছাড়িয়ে মঙ্গল ছুঁয়েছি । আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বলতে পারি আমরা ভারতীয় এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলো আমাদের ভারতবর্ষ।
জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়।
Comments
Post a Comment