হাওড়া ব্রিজ নির্মাণ কাহিনী এবং হাওড়া ব্রিজের কিছু অজানা তথ্য

 


কলকাতার নাম মুখে আনে সবার প্রথম যে বিখ্যাত এবং আশ্চর্যজনক জিনিসগুলোর কথা মাথায় আসে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু ।  এটা ভাবলেও আমাদের অবাক হতে হয় যে প্রবাহমান হুগলি নদীর বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ৭০৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজটিতে একটাও পিলার ব্যবহার করা হয়নি । তখনকার দিনের তৃতীয় বৃহত্তম এই ক্যান্টিলিভার ব্রিজ তৈরির পেছনের অজানা সব রহস্য নিয়ে তৈরি আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন আমরা জেনে নেব বর্তমান হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতুর ইতিহাস এবং নির্মাণ কাহিনী ।

৭৭ বছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ পথচারী এবং প্রায় ৩ লক্ষ যানবাহনের ভার সহ্য করে আসা এই আশ্চর্যজনক সেতুটি Gateway of Kolkata হিসেবে গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে আছে । 

হুগলি নদীর ওপর কেন এই ব্রিজটি তৈরীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে তা জানতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের সময় কালে । ভারতে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে সারা ভারতবর্ষের শাসন করতে শুরু করে।  তখনকার ভারতবর্ষের ব্রিটিশ রাজধানী ছিল কলকাতা । আরেকটু শুরুর দিকে ,সালটা১৮৫৫-৫৬  হুগলি নদীর দু'পাশে গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো বড় বড় কল-কারখানা । যমজ শহর কলকাতা এবং হাওড়ার মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলাটা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে , তাই দরকার পড়ে হুগলি নদীর ওপর একটি সেতু তৈরির । 


১৮৬২ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে দায়িত্ব দেন হুগলি নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য । ২৯ শে মার্চ তিনি প্রয়োজনীয় নকশা এবং উপাত্তসমূহ উপস্থাপন করেন কিন্তু সে সময় ব্রিজটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৮৭০ সালে ঠিক করা হয় যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতেই হবে এবং এর দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকবে না । ১৮৭১ সালে তৈরি হয় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট (যা বর্তমানে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ট্রাস্ট নামে পরিচিত ) । এই ট্রাস্টের অধীনে তৈরি হয় হুগলি নদীর ওপর প্রথম ভাসমান সেতু ,যা পুন্টন ব্রিজ নামে পরিচিত । ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৫৪৮ ফুট এবং প্রায় ৬২ ফুট চওড়া। স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া যেত । পুরনো এই হাওড়া ব্রিজের নকশা তৈরি করেছিলেন স্যার ব্রাডফোর্ড লেসলি, তিনি ছিলেন রেল কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার ।  এই ব্রিজটি তৈরি করতে তৎকালীন প্রায় ২২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিলো । 
            সেতু তো তৈরি হলো ! কিন্তু ভাসমান সেতুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাহাজ এবং স্টিমার যাতায়াতের ব্যবস্থা করা । যেহেতু জাহাজ গেলে গাড়ি চলাচলের জন্য সেতুবন্ধ হয়ে যেত ফলে সেতুর দু'পাশে তৈরি হতে লাগল তীব্র যানজট । ১৯০৬ সাল পর্যন্ত দিনের বেলাতেই কেবলমাত্র সেতু খোলা যেত । আর দিনের বেলাতেই যানজট ছিল অনেক বেশি ,যদিও ১৯০৬ সালের পর থেকে দিনের বেলাতেও সেতু খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । আগে যেখানে দিনে ২৪ বার সেতু  খুলতে হতো সেখানে মাত্র চার বার সেতু খুলতে হতো, কিন্তু এতে করেও যানজটের সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছিল না । তাই ব্রিটিশ প্রশাসন নতুন করে পরিকল্পনা করে সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভব করতে থাকে ।

            ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকার বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার R.S হায়েট এবং কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার W.B ম্যাকবের এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করে । কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভাসমান ব্রিজ এর পরিবর্তে একটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । ক্যান্টিলিভার নামটা শুনতে যতটা কঠিন মনে হচ্ছে বাস্তবে তা ছিল আরো বহুগুণ কঠিন । ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরিভাষায় ক্যান্টিলিভার বিম হলো এমন একটি বিম যে বিমের এক প্রান্ত দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে এবং অন্য প্রান্ত মুক্ত অবস্থায় থেকে ভার বহন করে , অর্থাৎ মাঝখানে কোন পিলার ছাড়াই ব্রিজটি তৈরি করতে হবে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার লেসলি সাহেবের কাছে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ এর পরিকল্পনা মুহূর্তে মনঃপুত হয়নি ,কারণ তখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে মাত্র তিনটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ তৈরি হয়েছিল তার ওপর ১৯১৭ সালে ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তিতে তৈরি কানাডার কুইবেক সেতু সেতু ভেঙে পড়ে তাই নতুন একটি ভাসমান সেতু পক্ষে মত দিয়েছিলেন কলকাতা পোর্ট কমিশনারের মত ছিল একই রকম । ১৯১২ সালে সারা বিশ্ব থেকে ৯টি  সংস্থা মোট আটটি নকশা জমা করে যার প্রত্যেকটি ছিল বাসকুল মডেল অর্থাৎ মাঝ বরাবর সেতু খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল প্রত্যেকটি মডেলে। এরই মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় সারা বিশ্ব সহ ব্রিটিশদের অর্থনীতি ও ধাক্কা খায় । ফলে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে নতুন কোন প্রকল্প হাতে নিতে চায়নি ।


            প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব কমতেই নতুন করে সেতু তৈরির কথা উঠতে লাগলো। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন আর এন মুখার্জি কে নিয়ে একটি কমিটি গড়ে দেন । রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম মালিক । তৎকালীন সময়ে মার্টিন এন্ড কোম্পানি ছিলো কলকাতার সমস্ত বড় বড় স্থাপত্য নির্মাণের প্রধান কারিগর । এই কমিটি তৎকালীন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মন্ট এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সিঙ্গেল স্প্যান আর্চড ব্রিজের  প্রস্তাব করেন । ১৯২২ সালের মুখার্জি কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্টে হুগলি নদীর ওপর একটি ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয় । ঠিক হয় এমন প্রযুক্তিতে সেতু তৈরি করা হবে যাতে সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসেই জাহাজ এবং স্টিমার  যাতায়াত করতে পারবে। এবং এরই জন্য ১৯২৬ সালে পাস হয় 'দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ এক্ট' । ১৯৩০  সালে ১৫ ই মার্চ বাংলার গর্ভনর বৈঠক ডেকে সেতু নির্মাণের জন্য নির্দেশ দেন।১৯৩৫ সালে নতুন করে হাওড়া ব্রিজ আইন সংশোধিত হয়। এবং ১৯৩৭  ব্রিজ নির্মাণ কার্য পাকাপাকি ভাবে শুরু করা হয়। 


            বর্তমান ব্রিজটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০৫ মিটার (২৩১৩ ফুট), প্রস্থ ৭১ ফুট (দুপাশে ১৫ ফুট করে ফুটপাত সহ ১০১ ফুট) ,এবং পিলারের উচ্চতা  ২৬৯ ফুট।

            ব্রিজটির নকশা তৈরি করেছিলেন ব্রেন্ডন,পামার এবং ট্রিটন নামক তিনজন খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার। ব্রিজটি তৈরি করতে এবং ফেব্রিকেশন এর তত্ত্বাবধানে ছিলো ব্রেথওয়েট বার্ন এন্ড যেসপ কনস্ট্রাকশন (B.B.J) কোম্পানি। ব্রিজটি তৈরি করতে তৎকালীন সময়ের প্রায় ২৫ মিলিয়ন বা ২.৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। সম্পূর্ণ ব্রিজটি তৈরি করতে প্রায় ২৬,৫০০টন ইস্পাত প্রয়োজন হয়েছিল যার মধ্যে ২৩ হাজার টন ইস্পাত সরবরাহ করেছিল ভারতের টাটা স্টিল । টাটা স্টিলের সরবরাহ করা এই High tensile alloy স্টীলের এর সাংকেতিক নাম ছিল TRISCOM. ।  ব্রিজটিতে আশ্চর্যজনকভাবে কোনও নাট বোল্ট এর ব্যবহার করা হয়নি ,এর  বদলে রিভেট জয়েন্ট বা মিটিং এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্রিজের নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়েছিল।  ফলস্বরূপ দীর্ঘ পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে বেমিসাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে কলকাতার বুকে তৈরি হয় বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম এই  ক্যান্টিলিভার সেতুর কাজ।

            দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্কালে জাপান দ্বারা মিত্রশক্তির পার্ল  হারবার বন্দরে বোমাবর্ষণ করা হয়। সেই ভয়ে ব্রিটিশরা বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজের কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নি । ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বপ্রথম ব্রিজটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেতুটির উপর দিয়ে সর্বপ্রথম একটি ট্রাম গাড়ি চালানো হয়েছিল ।
             আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তিতে তৈরি ষষ্ঠ বৃহত্তম এই ব্রিজটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ । ব্রিজটির বহনক্ষমতা ৬০,০০০ টন হলেও বর্তমানে এটিকে প্রায় এক লক্ষ টনেরও বেশি ভার বহন করতে হচ্ছে । শুধু কলকাতা নয় ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বে এই হাওড়া ব্রিজ হল অন্যতম দর্শনীয় একটি স্থান।  কলকাতায় এসে হাওড়া ব্রিজ দেখেননি এই রকম লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার । হাওড়া ব্রিজ নামেই বহুল পরিচিত হলেও তৈরীর সময় এটির নাম ছিল 'দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ' কারণ আগেই একই জায়গায় পুন্টন ব্রিজ নামে একটি ভাসমান হাওড়া ব্রিজ বাড়ানো হয়েছিল । এরপর ১৯৬৫ সালে হাওড়া ব্রিজ এর নাম বদলে এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে নতুন নামকরণ করা হয় 'রবীন্দ্র সেতু' নামে ।


             কিন্তু কলকাতার গর্ব এই হাওড়া ব্রিজ টি বর্তমান দিনে মানবজাতির কিছু অমানবিক কার্যকলাপের জন্য ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে । পথচারীদের পানের পিক এবং গুটকায় থাকা এসিডিক এবং লাইম যুক্ত উপাদান ইস্পাতের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ব্রিজের পিলারের সমূহ ক্ষতি করছে । পাখিদের মলমূত্রও ইস্পাতের ক্ষতি সাধণ করে ব্রিজটিরধ্বংস করছে বলে সমীক্ষকদের মতামত। এছাড়াও ব্রিজটির উপর অতিরিক্ত ট্রাফিকও ব্রিজটির জন্য মারাত্মক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যদিও এই সমস্ত বাধা দূর করতে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট ইতিমধ্যেই অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে,তবুও জনসাধারণের উচিৎ কলকাতার এই গর্বকে রক্ষা করার জন্য আরো অনেক সচেতন হওয়ার।

ইউটিউব ভিডিও
             

Comments

Post a Comment